শিশুশ্রম
-এস. আই. খান (শফিক)
বিপদজনক শ্রম হিসাবে শিশুশ্রম নামক বিষয়টির সাথে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ পরিচিত। প্রতিদিন ভয়ংকর হারে এই শিশু শ্রমের শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। অসহায় নাবালক এসব শিশুদের রক্ষার্থে নেই কোন যথার্থ উদ্যোগ। যতটা উদ্যোগ না নিলেই নয় একটি রাষ্ট্র হিসেবে নাম মাত্র কয়েকটি উদ্যোগ ছাড়া বাংলাদেশ তথা প্রতিটি দেশেই চলছে অবহেলার লুকোচুরি খেলা। শুধুমাত্র শিশুশ্রমের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত যে সকল বিষয় এসব শিশু নতুনভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তার উল্লেখযোগ্য প্রতিকার গ্রহণ করা হয়না। শিশুশ্রমকে নিরসনের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন এনজিও সংস্থা, সরকারসহ বিভিন্ন সংস্থা এর বিরুদ্ধে আলাপ, আলোচনা,পরিসংখ্যান তুলে ধরলেও এর ফলাফল কোনভাবেই আশানুরূপ পাওয়া যাচ্ছেনা। শিশুশ্রমকে ভিত্তি করে বিশ্বের বিভিন্ন এনজিও হাতিয়ে নিচ্ছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার, সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে চলছে জেনেভা কনভেনশনের মত শিশু ও শ্রমভিত্তিক নানা ধরণের আয়োজনের পায়তারা। যেখানে বিদেশ ভ্রমণ, ওয়ার্কশপের নামে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতা। আর এসকল প্রতিযোগিতা হয়ে আসছে পাল্লা দিয়ে দেশে দেশে এমনকি সারা পৃথিবীতে। এর পরও দেখা যাচ্ছে প্রতিদিনই জীবন ধারণ আর দু’বেলা আর দু’মুঠো অন্নের জন্য তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানা ধরণের ভয়ংকর কাজ। আর এসব করতে শিশুদের বাধ্য করছি আমরা সাধারণ মানুষ। আর সরকারে চোখ এ দিকে ফেরানোর কে-ই বা আছে?
সামাজিক বিশৃঙ্খলা, পারিবারিক কলহ, বিচার ব্যবস্থার উদাসীনতা, আইনের প্রয়োগহীনতা, প্রসাশনের অবৈধ যোগসাজস, অকাল মৃত্যু রোধে ব্যর্থতা, স্বাস্থ্যসেবার অবক্ষয়, সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণে ব্যর্থতা, অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দেয়া, নেশাদ্রব্যের অবাধ প্রাপ্যতা এমনকি আইন শৃঙ্খলার অবনতিই মূলত শিশুদের ভয়াবহ অতলগর্ভে পৌঁছে দিচ্ছে। শিশুরা যেখানে খেলাধুলা, বই-কলম নিয়ে থাকার কথা সেখানে তাদের নিজেদের খাওয়া আর পরিবারের খাওয়ার জন্য ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতম পেশায় নিজেদের বিলীন করে দিচ্ছে শুধু আমাদেরই কারনে। এ ব্যর্থতা আমাদের এবং এর দায় আমরা এড়াতে পারিনা। আমাদের সোচ্চার অংশগ্রহণের মাধ্যমে সরকারের যে উদ্যোগসমূহ বিদ্যমান অন্তত সেই সব কার্যক্রম বেগবানপূর্বক শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠনে আমার আপনার আমাদের সকলেরই এগিয়ে আসা উচিৎ।
সারা দেশে প্রায় ৪৫ লাখ শিশু নিষিদ্ধ শিশু শ্রমের শিকার। এদের সোনালী ভবিষ্যত অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। যে বয়সে তাদের খাতা কলম নিয়ে স্কুলে যাবার কথা ছিলো, ঠিক সেই বয়সে শুধুমাত্র দারিদ্র্যের কারণে আজ ওরা শিশু শ্রমিক। গত চার বছরে এই শ্রমিক বেড়েছে ১০ লাখ।
২০১১ সালের সরকারি একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সংখ্যা এমন পর্যায়ে পৌছে গেছে যে, পরিস্থিতি দিনের পর দিন বেড়্ইে চলেছে। দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা এখন প্রায় ৭৯ লাখ।
গ্রামাঞ্চলে শিশু শ্রমের প্রবণতা শহর অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি। ১৫ লাখ শিশু শ্রমিক শহরে এবং ৬৪ লাখ রয়েছে গ্রামাঞ্চলে শ্রমিক হিসাবে কাজ করছে। এই শিশু শ্রমিকদের মধ্যে ৪৫ লাখ শিশু শ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত প্রায় ১৩ লাখ শিশু এক সপ্তাহে ১শ ৬৮ ঘণ্টার মধ্যে কাজ করছে প্রায় ৯০ ঘণ্টা। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং আইএলও’র জরিপ অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রয়েছে ৪৫ ধরনের। আর এর মধ্যে ৪১ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করছে শিশুরা। শিশু শ্রমিকদের মধ্যে ৭৩ দশমিক ৫০ ভাগ পুরুষ শিশু এবং ২৬ দশমিক ৫০ ভাগ নারী শিশু।
শিশু শ্রমিকের ৬ দশমিক ৭০ ভাগ আনুষ্ঠানিক খাতে এবং ৯৩ দশমিক ৭০ ভাগ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে মোটর ওয়ার্কসপে কাজ করা, ওয়েল্ডিং, গ্যাস কারখানা, বেলুন কারখানা, লেদ মেশিন, রিকশা চালানো, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, বাস-ট্রাকের হেলপার, লেগুনার হেলপার, নির্মাণ শ্রমিক, গৃহ শিশু শ্রমিক, এমব্রয়ডারি, জাহাজ শিল্প, চিংড়ি হ্যাচারি, শুঁটকি তৈরি, লবণ কারখানা, বেডিং স্টোরের শ্রমিক, ইট ভাঙা, ইট ভাটা শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক, ট্যানারি এবং রঙ মিস্ত্রিসহ আরো বিভিন্ন ধরনের কাজ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর ২০০৮ সালের হিসেবে অনুযায়ী দেশে নবজাতক থেকে ১৭ বছর বয়সের শিশুর সংখ্যা ৬ কোটি ৭৭ লাখের বেশী। এদের মধ্যে প্রায় ৩৫ লাখ শিশু নানা ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত। মোট শিশু শ্রমিকদের মধ্যে ১৩ লাখ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। ২০০৮ সালের হিসেবে থেকে ২০১২ সালের হিসেবে যে পার্থক্য তৈরি হয়েছে তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সরকারি প্রকল্পগুলো তেমন একটা কাজে আসেনি। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ১০ লাখ। শুধু তাই নয় আগের চেয়ে নির্যাতনের মাত্রা কমেনি, বরং বেড়েছে।
শিশু শ্রমিকদের কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের মালিকরা স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক কোন আইনের তোয়াক্কা করছে না কেউ। এমনকি মজুরি কম দিয়ে প্রতিনিয়তই তাদের ঠকাচ্ছে। সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদ উপেক্ষা করে শিশুদের দিয়ে জোর করে কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অথচ এখন পর্যন্ত শিশু শ্রমের দায়ে বাংলাদেশে একজনকে শাস্তি পেতে হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় না।
শিশুর বয়স নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা রয়েছে। কত বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে ধরা হবে তা সুনির্দিষ্ট একটি আইনে বলা নেই। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা(আইএলও) শিশু আইনের বিভিন্ন ধারায় কাজের ধরনের ক্ষেত্রে শিশুর বয়স নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ১৬ থেকে ১৮ বছরের শিশুরা এই কাজ করতে পারবে। ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সের শিশুরা হালকা পরিশ্রমের কাজ করতে পারবে।
অন্য দিকে বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত একজনকে শিশু হিসেবে ধরা হয়েছে। আবার জাতীয় শিশু নীতিতে ১৪ বছর বয়সের কাউকে শিশু হিসেবে চিত্রিত করার বিধান দেওয়া আছে। ভিন্ন ভিন্ন বয়সের সুযোগ নিয়ে শিশুদের বিভিন্ন ধরনের কাজে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। আইনে শূন্য থেকে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের সবধরনের শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ৫ বছর বয়সের শিশুকেও জোর করে নানা ধরনের কাজে নিয়মিত ব্যবহার করা হচ্ছে।
জানা গেছে, সরকার ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধে আইএলও’র ১৮২ সনদে স্বাক্ষর করেছে। আইন অনুযায়ী শিশু বিক্রি, পাচার, ভুমি দাসত্ব, বেশ্যাবৃত্তি, অশ্লীল দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য শিশুর ব্যবহার, মাদক দ্রব্য উৎপাদন, মাদক পাচারে শিশুর ব্যবহার করাকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এই সনদ অনুযায়ী ১৬ থেকে ১৮ বছরের কম বয়সের কোন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবে না।
বাংলাদেশে শিশু শ্রমের অন্যতম বা প্রধান কারণ দরিদ্র্যতা। দেশের ৩১ দশমিক ৬ ভাগ মনুষ দরিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। এ সব পরিবারের সদস্যদের মাথাপিছু আয় দৈনিক ৮০ টাকারও কম। এদের অনেকের নূন্যতম কোন জমিও নেই। ফলে এসব পরিবারের শিশুরা তাদের পেটের ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য শিশু শ্রমে নিপতিত হয়। নিজেদের জন্য, পরিবারের জন্য তারা জীবন বাজি রেখে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতেও দ্বিধা বোধ করে না।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে অর্থাৎ শিশুশ্রম নিরসণ করতে হলে প্রয়োজন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বিত উদ্যোগ। সামাজিক বিশৃঙ্খলা রোধ করা, বিচার ব্যবস্থার সক্রিয়তা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, প্রসাশনের বৈধ পদক্ষেপ, অকাল মৃত্যু রোধে কার্যক্রম বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ, বাল্যবিবাহ নির্মূলকরণ, নেশাদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ইত্যাদিসহ পরিবারগুলোর আর্থিক সামর্থ্য বৃদ্ধি ও পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কারণ অধিকাংশ দরিদ্র্য পরিবারের বেশি সন্তান থাকে। শিক্ষা ব্যবস্থায় বৃত্তিমূলক শিক্ষা দিতে হবে। প্রয়োজনে এ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক স্তর থেকে কারিগরি স্কুলের ব্যবস্থা করে উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। যাতে তারা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা হতে পারে। আমাদের দেশের একটি শ্রেণী যারা শিশুদেরকে ব্যবহার করে সুবিধা ভোগ করার মত অপরাধে জরিত থেকে কোমলমতি শিশুদের জীবন বিপন্ন করে যাচ্ছে দিনের পর দিন তাদের চিহ্নিত করা আমাদেরই দায়িত্ব। তাদের আইনের হাতে তুলে দিয়ে সরকারকে সহায়তা করলে সরকার তার কার্যক্রমসমূহ আরও ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। এছাড়া, কঠোর শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ণের বিকল্প নেই। আইনের সঠিক ব্যবহারে চর্চা অব্যহত থাকলে শিশুদের একটি অনাবিল সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা যাবে তাতে সন্দেহ নেই।